যুক্তিহীন অযৌক্তিক যুক্তি
আবীর সগর্বে বন্ধু জনি কে বলল,
– তোর নীলাকে ভালোবাসা মোটেও উচিৎ হয়নি। নীলা আর যাই হোক, অন্তত তোর যোগ্য নয়। কী গুনটাই বা তার আছে? শুধু ফর্সা – সুন্দর নয় একটুও। তার উপরে খাটো। চোখ জোড়া কেমন যেন ভালো নয়। গালে তিল, চুল পাতলা তাও খাটো। ঠোঁট মোটা, বড় নাক, হাতে আবার লোমও আছে। গোঁফ থাকলেই হতো। ফিগারটা ভালো হলেও না হয় মানতাম। চালের বস্তার মতো দুই মন ওজন। বাপস্! আবার ছাত্রী হিসেবেও ভালো না। ভালো কিছু যে করবে, সেই যোগ্যতাও নেই। না পারে গাইতে, না পারে নাচতে। হাতের কাজও জানে না। তোদের প্রেম সার্থক নয়। আরে, জুটি হবে সোনায় সোহাগা। যেমন, গীতিকার স্বামীর গায়িকা স্ত্রী। তুই যে কোন যুক্তিতে ভালোবাসলি, কে জানে?
এই ধরনের বক্তব্য হজম করা যে কোন প্রেমিকার পক্ষে নিঃসন্দেহে কষ্টকর এবং অপমানজনক। কিন্তু জনি রা করলো না। বরং স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
– তুই যুক্তিবাদী এবং তোর যুক্তিও যথেষ্ট জোরালো। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে হয়তো তুইই ঠিক। কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। যেমন ধর, আমি কালো। নীলা ফর্সা। কালোর পাশে সাদাই মানায়। আবার আমি লম্বা, নীলা খাটো। আমেরিকাতে স্বামীর সাথে স্ত্রীর উচ্চতার গড় পার্থক্য এক ফুট। চোখ খারাপ হওয়া ইচ্ছাকৃত বা ব্যক্তিগত ক্রিটি নয়। অনেক সময় বংশও জড়িত থাকে। তিলে ক্রুটি খুঁজলে এক্ষেত্রে বলবো, তোর দৃষ্টি ভঙ্গিতে তিলা পড়েছে। তুই আরো বলেছিস, নীলার চুল খাটো। লম্বা চুল দিয়ে কি করবো বল? চুল দিয়ে তো আর লুঙ্গী বুনতে যাচ্ছি না। তাছাড়া আমার তো এমন দাবি নেই যে, চুল অবশ্যই ভালো হওয়া চাই। চুলে দোষের কথা অন্তত তোর মুখে সাজে না। ঠোঁট পাতলা হলে কি হতো? আমি কি বাঁশি বানিয়ে বাজাতে যাবো! কটা মেয়ের হাতে লোম খুঁজে পেয়েছিস তুই? এতো আমার জন্য বোনাস। তাছাড়া লোমে কী বা আসে যায়? দেখ! কোন মেয়ের ফিগার ভালো আর কোন মেয়ের ফিগার খারাপ, তা নিয়ে তোর মত মাথা ব্যথা আমার কোন কালেই ছিলো না। এবং নেই। তাছাড়া দুজনেই যদি শুটকি হই, তাহলে বাচ্চা – কাচ্চারা ত শুধু হাড় নিয়ে জন্মাবে রে। ভালো ভালো ছাত্রীদের মধ্যে আত্নবিশ্বাসরূপি একটা অহংকার সব সময় কাজ করে। তুই তো জানিস, অহংকার জিনিসটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না। আমি তো অভাবে নেই যে, নীলাকে চাকুরী করতে হবে। গান শোনার জন্য যথেষ্ট ক্যাসেট আমার আছে। আর টিভিতে তো প্রতিনিয়তই নাচ দেখায়। নীলা মাসের পর মাস ধরে সেলাই করবে, পাঞ্জাবীতে ব্লকের কাজ করে দেবে, শীতকালে উল বুনে সোয়েটার বানাবে আর আমি নাচতে নাচতে তা পড়বো – এমনটা আমি কখনো ভাবি না। যেখানে তার জন্য একটা জামা বা শাড়ি বানাবার ক্ষমতা আমার নেই। আর তোর গীতিকার স্বামীর গানের সুর কে করে দেবে? তুই করে দিবি?
এবার জনির কন্ঠে আদ্রতার কোমল পরশ লেগেছে। সে বললো,
– তোর কি নীলার নামের দিক একবার ও চোখ যায়নি? নিলে আছে সমুদ্রের গভীরতা, আকাশের অসীমতা, ভালোবাসার রঙের সার্থকতা। আর নিলাতো গভীরতম ভালোবাসার অসীমতার প্রতীক! বাস্তবিক নীল শব্দটি কেবল বাহ্যিকতা মাত্র। তুই যুক্তি দাঁড় করিয়েছিস। ভালোবাসার প্রথম ও প্রধান যুক্তি হলো – ভালোবাসা কোন যুক্তি মানে না। আপাতদৃষ্টিতে তোর যুক্তিগুলো অযৌক্তিক। যে কোথায় যুক্তি নেই সেটা যুক্তিহীন। সেহেতু, যুক্তিহীন ব্যপারটি অযৌক্তিক। অর্থাৎ, ভালোবাসা হলো যুক্তিহীন অযৌক্তিক যুক্তি। এই যুক্তির ব্যাখ্যা তুই কী দিবি? তাছাড়া, যুক্তি হিসেব করে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ন্য তুই বুঝবিই বা কি করে? যেহেতু তুই নীলাকে গুণহীন বলেছিস্, সেহেতু তার গুনটা তোকে জানানো আমার কর্তব্য হয়ে গেছে। নীলা যা, নীলা যতটুকু, তার পুরোটুকুর অধিকার সে শুধু আমাকেই দিয়েছে। সেখানে অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ। আমি ব্যতীত সেখানে অন্য কেউ ছিলো না, নেই ও থাকবেও না। এতোটাই তার শ্রেষ্ঠ গুন। যুক্তি দিয়ে এই গুনের অধিকারী কিংবা অধিকারিনী হওয়া কি সম্ভব?
পুনশ্চঃ বন্ধু হিসেবে আপনারা যারা আবীরকে অপছন্দ করতে শুরু করেছেন প্রথম থেকেই, কেবল তাঁদের জন্যই এই গোপন সংবাদ – আবীরের এই বক্তব্য ছিলো স্রেফ ঈর্ষাজনিত ঘটনার ফল। রক্ত মাংসে গড়া কঠোর যুক্তিবাদী আবীরও যুক্তির বাহিরে একটি মেয়েকে ভালোবাসে। সেই মেয়েটির নাম “নীলা”।
১৬/০৬/২০২২, ১০.০০ AM