স্বপ্নের রাজকন্যা ও আংটি কাহিনী
আমি তখন প্রবাসী। অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। পড়া-লেখা শেষ। ফুল টাইম জব করি, খাই, দাই আর ঘুমাই। আমার কোন মেয়ে বান্ধবী কিংবা গার্ল ফ্রেন্ড অথবা সংক্ষেপে যাকে বলে জি এফ এসব কিছুই নাই। একলা মানুষ। দিনের বেলা কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাত কাটতো না। কারন ঐ একটাই, আমার রুমমেট সহ যেদিকেই তাকাই সবারই কথা বলার জন্য পছন্দের মানুষ কিংবা প্রেমিকা বা ঐ জাতীয় কেউ আছে। কিন্তু আমার তো কেউ নাই।
দেশে আছে একমাত্র বোন আর ছোট এক ভাই, মা-বাবা। তাদের সাথে প্রতি রাতে কথা বলার পরেও এই মন কিছু একটা চাইতো, কাউকে খুঁজত। খুব চাইতাম এলোকেশী কেউ আমার মনের জানালায় উঁকি মারুক, আমার মনেও বসন্তের ছোঁয়া লাগুক। কিন্তু হায়, সবার কপালে কি আর সব সয়? আমি একা একাই থাকি। বন্ধের দিন গুলোতে আমি বিকেলে সিডনীর শপিং সেন্টার গুলোতে অথবা কোন এক সী বিচে ঘুরি ফিরি, কফি খাই, ক্ষানিক পরে বাসায় চলে আসি। শপিং সেন্টারে কিংবা বীচের পাড়ে আসা জোড়া জোড়া মানুষগুলোকে দেখি।
এমনি এক দিনে আমার রুমমেট প্লাস বেষ্ট ফ্রেন্ড সিহাব ভাই বললেন, তিনি দেশে যাবেন। তাই কিছু শপিং করবেন। আমি যাবো কিনা তার সাথে? ঘরে বসে থেকে কিছু করার ছিলো না। তাই আমিও এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। “হার্ষ্টভিল ওয়েস্ট ফিল্ড” শপিং সেন্টারে গিয়ে বন্ধু আমার শপিং করে আর আমি তার সাথে ঘুরি ফিরি। এক কাপড়ের দোকান থেকে আরেক কাপড়ের দোকানে যাবার সময় হঠাৎ করে “অ্যাঙ্গাস এন্ড কোটে” নামক ব্র্যান্ডেড এক ডায়মন্ডের জুয়েলারী শপের ওয়েডিং রিং সেকশনে আমার চোখ আটকে গেলো।
আমি সিহাব ভাইকে থামালাম। আমি তাকে একটা ডায়মন্ডের ওয়েডিং রিং এর দিকে আঙ্গুল তুলে বললাম,
– “সুন্দর না, রিং টা?”
সে রিং এর দিকে তাকায় একবার, আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “আপনি কি এখন ওয়েডিং রিং কিনবেন? পাত্রী পেলেন কবে?”
আমি এক সেকেন্ড না ভেবে তাকে বললাম,
– “ভাই, পাত্রী খুঁজলে পাত্রী পাওয়া যাবে বাট এই রিং আমি না কিনলে আর জীবনেও দ্বিতীয়টি পাবো না।”
বন্ধু আমার একটু ভেবে বলল,
– “দাম দেখেছেন?”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
– “টাকা তো লাইফে কামাবো, বাট আমার জীবনসঙ্গী হয়ে যে আসবে তার মূল্য এই অংটির থেকে অ-নে-ক বেশী। আমি এটাই নিবো।”
সামনে দাঁড়ানো সেলস্ গার্ল আমাদের দুই বন্ধুর বাংলা কথা বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইলো আর আমি তার দিকে তাকিয়ে রিংটা দেখিয়ে বললাম,
– “Could you please pack that wedding ring for me.”
মেয়েটি মিষ্টি হেসে প্যাক করে দিলো। আর আমিও ক্যাশ টাকা সাথে না থাকার কারনে ক্রেডিট কার্ডেই ওয়েডিং রিং কিনে বাড়ি ফিরলাম। ফোনে মা’কে যখন রিং এর ঘটনা খুলে বললাম, সে তো সব শুনে অবাক। সে আরেক কাহিনী। অন্য কোন সময় বলব।

দেশে এসেছি প্রায় তিন বছরের উপরে হয়ে গেলো। কিন্তু আজো আমার কেনা ওয়েডিং রিং তার যোগ্য মানুষের হাতে বসতে না পেরে মলিন প্রায়। যদিও বাসা থেকে যোগ্য পাত্রী’র “খোঁজ দ্যা সার্চ” চলছে। বাট ওয়েডিং রিং কেনার একটা ভালো দিক হলো, আমার যখন খুব মন খারাপ থাকে। তখন আমি রিংটা অনেক সময় নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখি। মন খারাপ ভাবটাও ভালো হতে শুরু করে, ধীরে ধীরে।
একটা সময় অনুভব করা শুরু করলাম, রিংটা আমাকে সান্তনা দেয়। বিশেষ কারো অপেক্ষায় থাকার আশার সঞ্চয় করে। আর তাইতো আমিও অপেক্ষার প্রহর গুনি। বিশ্বাস করি, জীবনে এমন একজন আসবে, যে মানুষটা অর্থ নয়, চাকচিক্য নয়, “জীবনে সুখি হওয়া এবং সুখি রাখার ছোট কিন্তু অসাধারন কিছু গুন” নিয়ে আমার জীবনে ভালোবাসার সুনামি বইয়ে দেবে। আর আমি পরম সুখে দু’চোখ বুঁজে তার হাতে হাত রেখে ভেসে যাবো অনাদিকালের পানে, তীরহীন সাগরের অতল গহ্বরে।
মূল লেখাঃ ২৩/১১/২০১৬, ৬.৪০ PM
ব্লগে প্রকাশঃ ১৯/০৪/২০২২, ১১.৪৫ AM
সর্বশেষ সংবাদঃ গত বছর অর্থাৎ ২০২১ এ আমি আমার কল্পনার রাজকন্যাকে হিরের আংটি পড়িয়ে আমার ঘরে প্রবেশ না করাতে পারলেও এমন একজনকে আমি জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি যে কিনা অর্থের চাকচিক্য নয়, “জীবনে সুখি হওয়া এবং সুখি রাখার ছোট কিন্তু অসাধারন কিছু গুন” নিয়ে সত্যিকার অর্থেই আমার জীবনে ভালোবাসার সুনামি বইয়ে দিয়েছে। নন্দিনী, আজকের এই লেখাটি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম।