সমাজ ব্যবচ্ছেদঃ প্রেক্ষাপট কিশোর অপরাধ
মানুষের সংজ্ঞা আসলে কি? কেউ বলে যার মধ্যে মান এবং হুঁশ আছে-সেই মানুষ। মান এবং হুঁশ ছাড়া তো মানুষ হতেই পারেনা। অনেকে বলে মানুষ হচ্ছে সংজ্ঞার উর্ধ্বে। মানুষের কোন সংজ্ঞা নেই। তবে ভালো বা খারাপ মানুষের সংজ্ঞা হতে পারে। তর্কশাস্ত্র বলছে Rationality + Animality = Man. সেই Rationality এবং Animality মানুষ জন্ম সূত্রেই অর্জন করে। পড়াশোনা করলে Rationality হয়তো বাড়তে পারে কিন্তু Animality একেবারে কমবে এই কথা বলা যায়না।
বিদ্যা মানুষকে বিনয়ী করে। কিন্তু আমাদের আশেপাশে তাকালে বিনয়ের পরিবর্তে অহংকার, হামবড়াই ভাব এবং উদ্যত আচরণই চোখে পরে বেশি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে এ যেনো তারই ইঙ্গিত বহন করে। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা যেনো মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ববোধকে কমিয়ে দিচ্ছে। এই জন্যই হয়তো আমরা কিশোর গ্যাং এর উত্থান দেখতে পাই। এক দশকে, বাংলাদেশ কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি, শিল্প ও বিভিন্ন খাতে হয়েছে বিশাল আকারের ডিজিটাইজেশন। সাথে আমরা দেখছি দেশে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা। দ্রুতগতির ফাইভজি নেটওয়ার্ক বাস্তবে পরিণত হতে আর বেশি দিন নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’র সুবিধা ভোগ করছে। এর মানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যায় অন্তর্গত কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বাকি অংশের তুলনায় বেশি।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা যেমন আশির্বাদ ঠিক তেমনই অভিশাপ ও বটে। আমাদের দেশে ক্ষেত্র বিশেষে অভিশাপের পরিমাণটাই বেশি। মোবাইলের অপব্যবহার বিশেষ করে ফেইসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমু, হোয়াটস এ্যাপস ইত্যাদি ব্যবহার করে তারা অনেক ভয়ংকর গ্রুপে সংঘটিত হচ্ছে। ইন্টারনেটের খারাপ দিকের প্রসঙ্গ উঠলে বেশীরভাগ সময়ই আমরা বুঝি উদ্দাম যৌনতা, নগ্নতাকে। কিন্তু আসলেই কি তাই? বর্বর সব ভিডিও দেখার প্রবণতা, মিথ্যা সৌন্দর্যের দিকে তরুণ সমাজের আগ্রহ (যেমন প্লাস্টিক সার্জারি, ইনজেকশন দিয়ে মেয়েদের ঠোঁট ফোলানোর বিকৃত প্রথা) এসবের মত আরও অনেক ট্রেন্ড বিশ্বব্যাপী তরুণ তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে জঙ্গিবাদের প্রবণতা বা গ্যাং তৈরির আগ্রহ কিন্তু শুরু হয় ঠিক এভাবেই।
২০১৭ সাল থেকে অদ্যাবধি র্যাব ২৭২ জন কিশোর গ্যাং সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছে। শুধু হত্যাকাণ্ডের পৃথক চারটি ঘটনায় মোট ২০ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এরপর র্যাব ২০১৯ সালে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক সেবন, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের সংশোধনাগারে প্রেরণ করেছিল, যা সে সময় দেশে আলোচনার শীর্ষে ছিল। পুলিশ ও র্যাব সূত্র বলছে, এখনো রাজধানীতে অন্তত ৭০ থেকে ৭৫টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। এদের সদস্য সংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজার। তাহলে এবার বুঝুন পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এরজন্য দায়ী আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা আর পারিবার। আমরা আমাদের প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে ব্যার্থ হয়েছি। ব্যার্থ হয়েছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে। আমি বলবোনা যে বর্তমান প্রজন্ম পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আয়ত্ত্ব করবে বা করতে পারবে। এই জন্য চাই উদ্দ্যোগ। চাই সঠিক মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবহুল কাহিনী সমৃদ্ধ গল্প – উপন্যাস – তথ্য চিত্র।
একটি বড় যুদ্ধ কিংবা আত্মত্যাগ, খুব সরলভাবে বললে, পরের দুই কিংবা সর্বোচ্চ তিন প্রজন্ম পর্যন্ত কিছুটা থাকে। ধীরে ধীরে তার গুরুত্ব, ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় আটকে যায়। যদিও আমাদের দেশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা যুদ্ধের যে চারটি স্তম্ভ ছিল, তার তাৎপর্য কতটা আছে তা নিয়ে বিতর্ক নাহয় আজকে নাই করলাম। পাশাপাশি বাংলা ভাষা নিয়ে ঝামেলা রয়েই গেছে। প্রযুক্তির নেশায় বুদ হয়ে এই প্রজন্ম বই পড়া ভুলে গেছে। বেশির ভাগ সময় তাদের মন আর মগজ বন্দি থাকে কম্পিউটার অথবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। তরুণ প্রজন্ম বই না পড়ার কারণে ধীরে ধীরে বাংলায় সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বাংলা এখন ধিরে ধিরে বাংলিশে রূপান্তরিত হচ্ছে। সমস্যা হল, উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে আমরা উন্নত হতে প্রায় সবকিছুই করছি। পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসাচ্ছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি সবকিছুর ভাল দিক যেমন থাকে, খারাপ দিকও থাকে।
পশ্চিমা দেশগুলো অনেক আগে থেকেই উন্নত। তাদের এই উন্নতির পেছনে রয়েছে তাদের মেধা ও পরিশ্রমের এক অনন্য মেল বন্ধন। তবে এই উন্নতির অন্ধকার দিক হল এই সিরিয়াল কিলারসহ ভয়ংকর সব অপরাধীরা। যারা শৈশব থেকেই উন্নত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়েছে, সবকিছু পেয়েছে, যা একটি শিশুকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে সাহায্য করে। কিন্তু এরপরও তারা ভয়ংকর সব অপরাধের পথ বেছে নিয়েছে। কেন? কারণ ভাল খাবার, ভাল শিক্ষাব্যবস্থা, উন্নত জীবন সবকিছু পাওয়া সত্ত্বেও এই মানুষগুলোর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ হয়নি। তারা খুন করেছে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যে নয়, স্রেফ কৌতূহলের বশে। এক ধরণের অসুস্থ উত্তেজনা পেতে। সবই যে খারাপ হচ্ছে তা বলা যাবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফেসবুকে #রেজএগেইন্সটরেপ ক্যাম্পেইন এবং লাইকির #নোমিনসনো ক্যাম্পেইন।
আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা একটা নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে সার্টিফিকেট নিয়ে বের হচ্ছে এবং আগামী দিনেও বের হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাড়পত্রের এখন অভাব নেই। অভাব হচ্ছে মনুষ্যত্ব বিকাশের। তবে তার মানে এই না যে, সার্টিফিকেটের কোনো দরকারই নেই। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জর্জ এলিয়ট বলেছেন, “No man can be wise on an empty stomach.” জীবিকার জন্য সার্টিফিকেটের প্রয়োজন অনস্বীকার্য, কারণ আগে তো বাঁচতে হবে।
পাশাপাশি সৃজনশীলতা বিকাশেরও সমস্যা রয়েছে। আমাদের সৃজনশীলতা বিকাশ সৃজনশীল প্রশ্নে আটকে আছে। আর বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে এর উত্তরও বই ছাপিয়ে বিক্রি করে। তাই এই সৃজনশীলতা কতটা কাজে লাগছে তাতেও যথেষ্ট বিতর্ক আছে। আমরা আসলে খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা ভুলেই যাচ্ছি। খালি মাঠ দেখলেই বাড়ি তৈরি করে ফেলি। কারণ এতে টাকা আসবে। কিন্তু এটা দেখছিনা সমাজের বিশেষ করে এই প্রজন্মের কতটা অধঃপতন হচ্ছে।
আঠারো শতকের শেষে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের জন্য স্যালফোর্ড ল্যাডস ক্লাব নামে ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিল গ্রোভস্ পরিবার। আজ একে আমরা ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব নামে চিনি। রবার্ট ব্যাডেন পাওয়েল, যিনি স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বৈশ্বিকভাবে পরিচিত, তার হাত ধরেই এ ক্লাব সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। এভাবে সৃজনশীল কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিলে এবং উন্নয়নমূলক কাজের দিকে আগ্রহী করে তুলতে পারলে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ ভালোর দিকে যাবে বলে আশা করা যায়। পাশাপাশি নৈতিকতা বিকাশেরও দরকার। এক্ষেত্রে ধর্মীয় শিক্ষার কথা আসে। ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়।
০৭/০৬/২০২২, ১০.০০ AM