জাপানঃ নিঃস্বার্থ এক বন্ধুর নাম
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখবো বিভিন্ন দেশের সাহায্য। তবে সবচেয়ে বেশি দেখবো জাপানের সাহায্য। জাপান বাংলাদেশকে কিরকম সাহায্য করে? এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে বিশ্বব্যাংক সাহায্য করতে অস্বীকার করলেও জাপান সাহায্য নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করলে দেখা যাবে যে, জাপান সেইসব জায়গায় তাদের অর্থ প্রদান করেছে যে সব জায়গায় অর্থ দিলে বাংলাদেশের আসলেই উন্নতি হয়। উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের কথাই ধরা যাক। ২০১৪ সাল থেকে জাপান বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ শুরু করে। এর ফলাফল এখন আমরা সবাই জানি। ‘বিদ্যুৎ আসে” বলা আমরা এখন ‘বিদ্যুৎ যায়” বলা শিখেছি। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ১৯৭২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জাপান বাংলাদেশে ২৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সাহায্য করেছে। যার প্রায় ৪৭ শতাংশের কিছু বেশি ছিল অনুদান এবং অবশিষ্ট অংশ সহজ শর্তে ঋণ। মোট সাহায্যের ৪২ শতাংশই ছিল প্রকল্প সাহায্য।



এই সময়ে জাপানই ছিল বিশ্বব্যাংকের পর বাংলাদেশের জন্য এককভাবে বৃহত্তম দাতা দেশ। এখন প্রশ্ন আসতে পারে জাপান কেনো বাংলাদেশকে নানা ভাবে সাহায্য করে আসছে? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ভুলে যাওয়া ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে। ড. রাধাবিনোদ পাল। একজন ভুলে যাওয়া বাঙ্গালী বিচারক। যিনি ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের ঐতিহাসিক টোকিও ট্রায়ালের ১১ জন বিচারপতিদের মাঝে অন্যতম ছিলেন। বলা যেতে পারে তাঁর একক রুখে দাঁড়ানোতে জাপান অনেক বড়ো বিপদ থেকে বেঁচে যায়। এমদাদ হাসনায়েন ও সারিয়া সুলতানা তাদের ‘কুষ্টিয়ার ইতিহাস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, “‘টোকিও ট্রায়াল’ ধাপে এই বাঙালি বিচারকের দৃঢ় অবস্থানের কারণেই জাপান অনেক কম ক্ষতিপূরণের উপর বেঁচে গিয়েছিলো। নয়ত যে ক্ষতিপূরণের বোঝা মিত্রপক্ষ ও অন্য বিচারকরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তার দায় এখন পর্যন্ত টানতে হত জাপানকে।”
ড. রাধাবিনোদ পাল তার রায়ে লিখেছিলেন, ‘জাপানকে এককভাবে যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করা হলে এটি হবে চরমতম ভুল। কারণ বাকি দেশগুলোও ভয়াবহভাবে যুদ্ধাপরাধ করেছে। এর অন্যতম উদাহরণ ছিল হিরোশিমা নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ। হিরোশিমায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪ হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়। যুদ্ধাপরাধের জন্য যদি জাপানের বিচার করতে হয় তবে বাকিদেরও বিচার করতে হবে।’ এই বিচারের অভিযোগ প্রক্রিয়া ছিল তিনটি ধাপে। প্রথম অভিযোগ, শান্তির বিপক্ষে অপরাধ। দ্বিতীয় অভিযোগ, প্রচলিত যুদ্ধাপরাধের বিচার। তৃতীয়ত, মানবতাবিরোধী অপরাধ।

এই বিচারের রায় ছিল মোট ১ হাজার ২৩৫ পৃষ্ঠার। রাধা বিনোদ পাল তার রায়ে শেষের দুটি ক্ষেত্রে আপত্তি তোলেন। তিনি বলেন, জাপান যখন যুদ্ধে গিয়েছিল তখন এই অপরাধের জন্য কোনো আইন ছিল না। এই আইন তৈরি হয়েছে পরবর্তীতে। জাপান যখন যুদ্ধে গিয়েছিল তখন এই বিষয়ে কিছুই জানত না। সুতরাং বর্তমানে আইন তৈরি করে আগের অপরাধের বিচার করা যৌক্তিক না। জানা আর অজানা অপরাধের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এই বারোশ বত্রিশ পাতা জুড়ে লেখা সেই অকাট্য যুক্তি জাল দেখে অধিকাংশ জুরী অভিযুক্তদের Class-A থেকে B তে নামিয়ে আনেন, রেহাই পান তারা নিশ্চিত মৃত্যুদন্ডের হাত থেকে। মি. লাল বলেন,
– “মজার বিষয় হল, রাধা বিনোদ পালের ৮০০ পৃষ্ঠার রায়টি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই জাপানে সেটিকে নিষিদ্ধ করে অধিগ্রহণকারী মার্কিন বাহিনী। আর ঠিক যেদিন মার্কিন বাহিনী জাপান ছেড়ে যায়, ঠিক সেদিন রায়টি জাপানে প্রকাশিত হয়।”

রাধা বিনোদ পাল কেবল রায়ের মধ্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি। বিচারের চার বছর পরে ১৯৫২ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমার শান্তি স্মৃতি উদ্যানে দাঁড়িয়ে পারমাণবিক বোমা হামলার অষ্টম বার্ষিকীতে জাপানিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,
– ‘যদি আবার জাপানিরা যুদ্ধে জড়ায় তবে হিরোশিমার সেই নৃশংসতায় নিহত নিরীহ মানুষদের প্রতি চূড়ান্ত অবমাননা করা হবে।’
জাপান নিয়ে আরো লেখা পড়ুন –
- জাপান নামা
- যুক্তিযুক্ত দিবস
- মনিব ভক্ত হাচিকো
- চোরনামা নাকি জাপাননামা
- সংসদ বায়োষ্কোপ কিংবা চিড়িয়াখানা
- জুনকো ফুরুতা – নিকৃষ্টতম নির্মমতার শিকার
সে বছরই বিচারের রায় মেনে নিয়ে সান ফ্রান্সিসকো শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে জাপান। এর ফলে জাপানের দখল ছেড়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জাপানিরাও তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘জাপান কখনোই আর যুদ্ধে জড়াবে না এবং সব সময় শান্তির পক্ষে থাকবে।’ প্রয়াত হিরোহিতো জাপানের সম্রাট থাকাকালে একবার বলেছিলেন,
– “যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধু।”
পরবর্তীতে রাধা বিনোদ পাল দু’বার জাপানে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সফর করেন। ১৯৬৬ সালের অক্টোবরে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো তাকে জাপানের সর্বোচ্চ অ্যাকাডেমিক খেতাব ‘ফার্স্ট অর্ডার অব সেক্রেড ট্রেজার’ প্রদান করেন। রাধাবিনোদ পালকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করা হয় নিহোন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ১৯৬৬ সাল। জাপান সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে জাপানের সর্বোচ্চ সম্মানীয় পদক ‘কোক্কা কুনশোও’ গ্রহণ করেছিলেন। জাপানের রাজধানী টোকিওতে তার নামে রাস্তা রয়েছে। কিয়োটো শহরে তার নামে রয়েছে জাদুঘর, রাস্তার নামকরণ ও স্ট্যাচু। টোকিও ট্রায়াল টেলিসিরিয়ালটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের ট্রায়াল নিয়ে নির্মিত হলে তার চরিত্রে অভিনয় করেন ভারতীয় অভিনেতা ইরফান খান।
২৪/০৪/২০২২, ১০.২০ AM
তথ্যসূত্রঃ
১। বিবিসি বাংলা
২। উইকিপিডিয়া বাংলা
৩। দ্যা ডেইলি ষ্টার পত্রিকা
৪। এমদাদ হাসনায়েন ও সারিয়া সুলতানা রচিত ‘কুষ্টিয়ার ইতিহাস’