আইন ও আদালতবাংলাদেশ

বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা

আইনজীবী হিসাবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরলাম। 

জাতি হিসাবে যদি সৎ হতাম তাহলে প্রচলিত আইন ব্যবস্থা থেকেই আমরা অনেক উপকৃত হতাম। নারী ও শিশুদের রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নাম একটি চমৎকার আইন প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা এই আইনের এত অপব্যবহার করেছে যে কোর্ট এখন সত্যিকার কেস ও বিশ্বাস করে উঠতে পারেন না। কেবলমাত্র কিছু বানোয়াট উপাদানের কারণে কত সত্যিকার নারী শিশু কেস যে হেরে যেতে দেখেছি তার কোনো লেখা-জোখা নেই। কেস দেয়ার সময় লোকেরা সম্ভবত মনে করে কিছু বাড়িয়ে বলি তাহলে জিনিষটা পোক্ত হবে। কিন্তু তাদের মাথায় এটা কখনো আসেনা যে, এই মিথ্যা উপাদান গুলি দেখিয়েই আসামী পক্ষের উকিল কেস জিতে যাবে।

একজন আইনজীবী হিসাবে খোলামনে স্বীকার করছি, যদি কোনো বাদী কেবলমাত্র সত্য ঘটনা বর্ণনা করে মামলা করেন তাহলে সেই আসামীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। অনেক সময় খবরে দেখবেন অনেক কুখ্যাত সন্ত্রাসী বিনা শাস্তিতে বের হয়ে এসেছে, এটা দেখে আপনি খুব সম্ভবত উকিল-পুলিশ-বিচারক সবাইকে এক নিশ্বাসে কয়েকটা গালি দেবেন এবং তারপর ভুলে যাবেন। মিডিয়াতে যদিও প্রায়ই বলা হয় ‘আইনের ফাঁক গলে’ ইত্যাদি ইত্যাদি, আসলে ফাঁকটা আইনের না বরং আইনজীবিদের।

আপনাদের ধারণা থাকতে পারে যে আইনজীবী মাত্রেই জেরায় খুব পটু হয়। ব্যপারটা আদতে তা নয়। শুনলে আপনাদের বিশ্বাস হবে না জানি না কিন্তু ঢাকা বারের ১০ সহস্রাধিক আইনজীবীর মধ্যে ১০ জন আইনজীবিও হাই প্রোফাইল কেসে জেরা করার দক্ষতা রাখেন না। আমি কথাটা জেনে শুনেই বলছি কারণ কোনো এক সময় আমি এই ‘টপ টেন’ এর প্রত্যেক আইনজীবীকে চিনতাম এবং তারাও আমাকে ভালোভাবেই চিনতেন। 

সচরাচর কোনো অপরাধের ভুক্তভোগীরা আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে থাকে, তারা প্রথম সারির আইনজীবিদের নিয়োগ করতে পারে না। প্রথম সারিদের নিয়োগ করে আসামীরা। ফলাফল খেলনা ট্যান্ক নিয়ে আসল ট্যান্ক এর সাথে যুদ্ধ করলে যা হবার তাই হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমরা আসামী পক্ষের উকিলেরা যে পরিমান টাকা এবং সুবিধার মধ্যে গড়াগড়ি খেতাম, বাদী পক্ষের উকিলেরা সেটা কল্পনাও করতে পারতো না। 


আইন সম্পর্কে আরো লেখা পড়ুন –


বাদী পক্ষের আরেকটা বড় সমস্যা হয়, যে সমস্যাটিকে বাংলাদেশের আইন বাব্যস্থার জন্মগত দোষ বলা ছাড়া আর কিছু বলার নেই। বাদী পক্ষের সকল কেসের নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকার নিয়োজিত আইনজীবিদের হাতে (পিপি বা পাবলিক প্রসিকিউটর)। বাদী পক্ষ যত ভালো উকিলই নিয়োজিত করুক না কেন তাকে সরকারী উকিলের কথা মতই কাজ করতে হয়। এই পিপিদের সাধারণত নিয়োগ দেয়া হয় দলীয় অনুগাত্যর ভিত্তিতে ফলে এদের পারফরমেন্স সম্পর্কে আর কিছু বলা বাহুল্য মাত্র।

তবে কি সব পিপি অযোগ্য? মোটেই না। আমি পেশাগত জীবনে অসাধারণ কিছু পিপির দেখাও পেয়েছি। কিন্তু আসামীরা যদি সরকারী দলীয় হয় (যা হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল) তাহলে দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া একজন পিপি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কতখানি কার্যক্রমের ক্ষমতা রাখেন বা সাহস করবেন? এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, বাদিপক্ষকে বিদেশী আইন ব্যবস্থার মত নিজ খরচে এবং নিজ পছন্দ অনুযায়ী উকিল নিয়োগ করার ক্ষমতা দেয়া হোক। সরকারী পিপিদের নজরদারী ছাড়া সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারবে। এই সুবিধাটা দিতে সরকারের কোনো বাড়তি খরচ হবে না, কিন্তু আইনের শাসন অনেকাংশে নিশ্চিত হবে। 

থানায় গেলে কেস নেয় না এই মর্মে বাংলাদেশ পুলিশ এর একটা কঠিন বদনাম আছে যা অনেকাংশে সত্য। কিন্তু ব্যপারটা পুলিশদের নজর দিয়ে দেখলে অন্যরকম মনে হবে। আইন পেশায় জড়িত থাকার সুবাদে বাংলাদেশের মানুষদের কিছু প্রবণতা আগে থেকেই জানা ছিল, কয়েকদিন আগে আবার তার প্রমান পেলাম। একটা জিডি করতে পল্লবী থানায় গিয়েছিলাম। আমি সেখানে বসে জিডিটা লেখার সময় আরো কিছু লোক থানায় এজাহার দেবার জন্য আসলেন। তাদের বক্তব্য শুনে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম প্রত্যেকটা কেস ভুয়া। তারা থানায় মামলা করতে এসেছেন এসেছেন কেবল মাত্র মানুষকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে।  আমি বলছিনা অসৎ পুলিশ নেই কিন্তু আমাদের আম জনতাও যে ক্ষেত্র বিশেষে কতখানি অসৎ এবং প্রতিহিংসা পরায়ন সেই খবর কি আমরা রাখি?

১৯/০৪/২০২২, ১০.৩০ AM

Kazi Wasimul Haque

পেশায় আইনজীবি। কোর্ট প্র্যাক্টিসের পাশাপাশি আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখতে ভালোবাসি। আমি কাজী ওয়াসীমুল হক, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট এ প্র্যাক্টিস করছি। সেই সাথে আমি ওয়াসীমুল হক এন্ড অ্যাসোসিয়েটস্‌ এর প্রধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *