দাড়ি বিহীন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
চরিত্রহীন উপন্যাস বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামডাক। আলোচনা-সমালোচনায় তিনি তখন তুঙ্গে। সবখানেই বইটির দারুণ কাটতি। প্রকাশকেরা তাঁর বাড়িতে হানা দিতে লাগলেন, এমন বই-ই তাঁদের চাই। এমন সময় দেখা গেল শরৎচন্দ্রের আরেকটি নতুন উপন্যাস বেরিয়েছে — চাঁদমুখ। তাঁর পরিচিত প্রকাশকেরা এবার খেপলেন, খেপলেন বন্ধুবান্ধবও। কাউকে না জানিয়েই আরেকটি বই প্রকাশ করে ফেললেন শরৎবাবু! চরিত্রহীন-এর মতো এ বইও খুব বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যেই শরৎচন্দ্র হঠাৎ বললেন,
– ‘এ বই আমি লিখিনি!’
শরৎচন্দ্রের প্রকাশক এবার হইচই শুরু করে দিলেন, তাহলে কী হচ্ছে এসব! জানা গেল, কেউ ‘নকল’ শরৎচন্দ্র সেজে বাজারে বই ছাড়ছে। কিন্তু আসল শরৎচন্দ্র ব্যাপারটা কানেই তুললেন না। ওদিকে তাঁর প্রকাশক হরিদাসবাবু নাছোড়বান্দা। তিনি ব্যবসায়ী, মেলা খরচ করেছেন শরৎচন্দ্রের বইয়ের পেছনে। এখন যদি অন্য কেউ এসে ব্যবসা ধরে বসে, তাহলে তাঁকে পথে বসতে হবে। কিন্তু আসল শরৎচন্দ্র বললেন,
– বই পড়ে পাঠকই বুঝে নেবে, কে খাঁটি আর কে ভেজাল।
কিন্তু এমনটা ঘটেনি। লেখা পড়ে আমজনতার খুব অল্পই আসল-নকল শরৎচন্দ্রকে বুঝতে পেরেছে। এদিকে তাঁর নামে হীরক দুল ও শুভ লগ্ন নামে বই বেরিয়ে গেল আরও দুটি। কিন্তু কে এই ‘নকল’ শরৎচন্দ্র? তিনি হলেন গল্প লহরী পত্রিকার সম্পাদক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সে সময় তাঁর খুব দুর্দিন চলছিল। পত্রিকা চলে না। শেষে শরৎচন্দ্র নামটা পুঁজি করে নেমে গেলেন উপন্যাস রচনায়। নামটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হওয়ায় বইয়ের কাটতিও হলো ভালো। সুতরাং তিনি আর থামলেন না। এত দিনে বোধোদয় ঘটল আসল শরৎচন্দ্রের। কিন্তু সমাধান কী? নতুন এই শরৎচন্দ্রের নামে তো আর মামলা-মোকদ্দমা করা যায় না। আবার এককথায় তাঁকে নকল ঠাওরানোও কি ঠিক হবে! ওই বেচারাও তো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
এগিয়ে এলেন বাতায়ন পত্রিকার সম্পাদক অবিনাশ ঘোষাল। শরৎবাবুর খাস লোক ছিলেন তিনি। তাঁর কাছেই কেবল নিজের পেটের কথা বলতেন শরৎচন্দ্র। দুজনে বসে অনেক ফন্দিফিকির করলেন, কীভাবে থামানো যায় ব্যাটাকে! তবে কোনোটাই মনঃপূত হলো না শরৎচন্দ্রের। একবার অবিনাশ বলেন,
– ‘বরং আপনিই চলে যান তার কাছে। আপনাকে ফিরিয়ে দেবে না। বিহিত একটা হবেই।’
তবে এ প্রস্তাব পছন্দ হলো না শরৎচন্দ্রের। পরে তিনি বললেন,
– ‘অবিনাশ, তুমিই যাও। গিয়ে তাকে মারপিটের ভয় দেখাও। বলো, চরিত্রহীন প্রকাশের পরে অনেকেই শরৎচন্দ্রকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করছে। সিটি কলেজের ছেলেরা মারতেও পারে। এখন যদি আপনি শরৎচন্দ্র নামে লেখেন, তবে কখন আবার বিপদে পড়েন।’
অবশেষে অবিনাশ ঘোষালই গেলেন ওই শরৎচন্দ্রের কাছে। প্রস্তাব করলেন নাম পাল্টানোর। কিন্তু না, ওটা করবেন না তিনি। শেষমেশ গল্প লহরীর শরৎচন্দ্র বললেন,
– ‘এক কাজ করা যাক, বইয়ে বড় করে আর্ট পেপারে ছবি ছাপলেই তো মামলা খতম। আমি আমার বইয়ে ছবি ছাপব, তিনিও যেন তাঁর বইয়ে ছবি ছাপেন।’
এ কথার ওপর ফিরে গেলেন অবিনাশবাবু। মাসখানেক পর গল্পলহরীর শরৎচন্দ্রের নতুন বই বাজারে এল কণকাঞ্জলি নামে। টাইটেল পেজের সামনের পেজে বড় করে লেখকের দাড়িসমেত ছবি দেওয়া হলো, নিচে লেখা ‘শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (জুনিয়র)’। এ সপ্তাহেই অবিনাশ ঘোষাল তাঁর বাতায়ন পত্রিকায় আসল শরৎবাবুর ছবি ছাপতে চাইলেন। কিন্তু সমস্যা আছে এখানেও। আসলজনেরও দাড়ি আছে, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। এখন দুজনেরই যদি দাড়িযুক্ত ছবি ছাপা হয়, তবে লোকজনের চিনতে সমস্যা হবে। কী করে আসল শরৎকে চিনবে তারা! অগত্যা শরৎচন্দ্র তাঁর শখের দাড়ি কাটলেন। অতঃপর দাড়িহীন সে ছবি ছাপা হলো বাতায়ন-এ। ছবির নিচে লেখা ছিল, ‘চরিত্রহীন উপন্যাসের লেখক শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’।
০৩/০৯/২০২২, ১০.০০ AM
তথ্যসূত্র: সাগরময় ঘোষের সম্পাদকের বৈঠকে।