জাপানের গাড়ি কাহিনী
টয়োটার সাথে একটা মিটিং হলো। ৪ ঘণ্টা লম্বা মিটিং। টিমে নতুন একজন সদস্য যুক্ত হলেন – যার কাজ হলো আগামী ৩০ বছরের মধ্যে গাড়ির চেহারা কেমন হবে, গাড়ি দিয়ে কী কী সার্ভিস দেয়া সম্ভব হবে সে নিয়ে গবেষণা করা। আমরা গত ছয় বছর ধরে ওনাদের সাথে যৌথ গবেষণা করছি। গবেষণার উদ্দেশ্য হল -মোবিলিটি আর তথ্য প্রযুক্তি কিভাবে ছোট ছোট সামাজিক সমস্যা সমাধান করতে পারে সে নিয়ে নতুন নতুন আইডিয়া তৈরি করা, আইডিয়া গুলো সত্যিকার ফিল্ডে টেস্ট করে দেখা, টেস্ট ফিল্ড থেকে কারিগরি সমস্যা গুলো লিস্ট করে নতুন নতুন গবেষণার সুযোগ তৈরি করা। এই চক্র চলতেই থাকবে যতদিন সমাজে সমস্যা থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাভ হলো গবেষণার যাবতীয় খরচ ইন্ডাস্ট্রি বহন করবে। ইন্ডাস্ট্রির লাভ হলো নতুন নতুন আইডিয়া/প্রযুক্তি উন্নয়ন করবে- ব্যবসায় উপযোগী হলে ব্যবসায় নেমে যাবে। সেখান থেকে লভ্যাংশ দিয়ে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে সাহায্য করবে। উইন-উইন সিচুয়েশন। বাংলায় কি বলবো? জয়-জয় কারবার?
কথায় কথায় জিজ্ঞাস করলাম- আচ্ছা, এই যে ড্রাইভার-হীন অটো-ড্রাইভিং টেকনোলজির জন্য এতো টাকা পয়সা ব্যয় হচ্ছে, সমাজ কি সত্যিকারে এই ড্রাইভারহীন গাড়ি মেনে নেবে? ড্রাইভার-হীন গাড়ির ওপর লোকের আস্থা কেমন? জিজ্ঞাস করেই একটু ধাক্কার মত খেলাম। কারণ –
(১) টোকিও তে ড্রাইভার-হীন ট্রেন চলে কয়েক দশক হলো। যদি ও ড্রাইভার-হীন ট্রেন চলা আর গাড়ি চলা ভিন্ন কথা।
(২) আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ড্রাইভার-হীন গাড়ি চলছে পরীক্ষামূলক ভাবে বছর খানেক হলো।
একজন থামিয়ে দিয়ে বললেন, সমস্যা টা শুধু টেকনোলজিতে নয়। পলিসিতে ও। গাড়ি চলে কোন একটা ন্যাভিগেটরের মাধ্যমে। ন্যাভিগেটর ব্যবহার করে কোন একটা ম্যাপ। ধরুন ম্যাপ দেয় গুগোল। গুগোল চাচা পরিষ্কার বলে দিয়েছে দুর্ঘটনার দায়ভার সে নেবে না। তাছাড়া ১৯৪৯ সালের জেনিভা কনভেনশনে পরিষ্কার লেখা আছে, গাড়ি চালাতে হলে ড্রাইভারকে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে থাকতে হবে। প্রত্যেক দেশে ড্রাইভারদের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক। গাড়িকে এই লাইসেন্স দেবে কে? এই পলিসি গুলো নিয়ে বিবেচনার দরকার আছে।
প্রযুক্তি মানুষের কাজে লাগলে পলিসি ফিক্স করা যাবে। জাপানে এই প্রযুক্তি কী কাজে লাগবে? আগামী দশ বছরের মধ্যেই জাপানে বুড়ো-বুড়িদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। গ্রাম গুলোতে তরুণ তরুণীদের সংখ্যা কমবে। গ্রামে জনবসতি থাকবে কম। বাড়িতে বাড়িতে শুধুই বুড়ো বুড়ি। এই বুড়ো বুড়িদের হাতে টাকা থাকবে কিন্তু টাকা ম্যানেজ করতে পারবেনা। গাড়ি থাকবে কিন্তু গাড়ি চালাতে পারবেনা। রান্নাঘর থাকবে কিন্তু রান্না করতে পারবে না। এই সমস্যা কে ট্যাকেল করতে কত টেকনোলজি, কত ব্যবসা নিয়ে মগজ খাটানো শুরু হয়ে গেছে।
জাপান সম্পর্কে অন্যান্য লেখা পড়ুন –
একটা উদাহরণ দেই। রেস্টুরেন্ট, গাড়িওয়ালা, হোম ডেলিভারি ওয়ালারা আর ই-কমার্স ব্যবসায়িরা নেমে তৈরি করলেন খাবার ডেলিভারি দেয়ার সার্ভিস। নবিতার নানি নবিতার নানা কে বলছে,
– ও নবিতার নানা, তুমি কি বাজারে যাইবা নাকি ড্রয়িং রুমে বইসা শুধু টিভিই দেখবা? বাসায় চাউল নাই, মাছমাংস নাই, সরিষার তেল নাই। কয় বছর হইল হাজি বিরিয়ানি খাইনা। তোমার সাথে শুধু আমি বলেই সংসার করে যাচ্ছি, অন্য কেউ হলে কবে বাপের বাড়ি চলে যেত।
নবিতার নানা স্মার্ট ফোন খুললেন, মুদির দোকান থেকে পেয়াজ, মাছের দোকান থেকে মাছ , হাজি বিরিয়ানির দোকান থেকে বিরিয়ানি অর্ডার দিলেন। ই-কমার্সের ড্রাইভার-হীন গাড়ি সব গুলো দোকানে গেল। গাড়ির মধ্যে আছে কয়েন লকারের মতো এক ধরণের লকার। গরম খাবার রাখার জন্য গরম তাক, ঠাণ্ডা মাংস রাখার ফ্রিজিং তাক। নবিতার নানার সিলেক্ট করা লকারে বাজার ঢুকে গেল। ড্রাইভার-হীন গাড়ি বাড়ির কাছে পৌছা মাত্র ফোন চলে এল নবিতার নানার কাছে। বাড়ির আঙ্গিনায় গাড়ি হাজির। মোবাইল ফোনের QR কোড দিয়ে লকার খুললেন, বাজার নিলেন। নবিতার নানিকে দিয়ে বললেন,
– এই লও তোমার বাজার।
নবিতার নানি, নবিতার নানার সংসারে সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগলেন। এটা কোন সায়েন্স ফিকশন নয় রে ভাই। জাপানের কানাগাওয়া অঞ্চলে যারা আছেন তারা এখনি অর্ডার দিতে পারেন। ডেলিভারির জন্য কোন খরচ নেই। বাংলাদেশ উন্নত হচ্ছে। বাসায় কাজের লোকের সংখ্যা কমছে। আরো কমবে। গৃহস্থালি কাজ গুলোর জন্য শীঘ্রই আমাদের সুলভ মূল্যের টেকনোলজি বানাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় আর ইন্ডাস্ট্রি গুলো মিলে কাজ করার এটাই মোক্ষম সময়।
২৪/০৬/২০২২, ১০.০০ AM