জব ইন্টারভিউঃ পূর্ব প্রস্তুতির আদ্যোপান্ত
বাহ, আপনি তো দেখি পুরাই কাইত করে দিয়েছেন। আসেন, আসেন। বসেন, চা খান। আপনি কঠিন প্রিপারেশন নিয়েছেন, পরিশ্রম করে পড়ালেখা করেছেন, ফোন ইন্টারভিউ পাস করেছেন এবং এখন তারা আপনাকে নিশি ডাকের মতো ডাকছে তাদের গুহায় পা দিয়ে তাদের ধন্য করতে। দু চক্কোর নেচে নিন। কারন আপনি এটা ডিজার্ভ করেন এবং এটাই আপনার ফাইনাল টেস্ট। ভাববেন না, তারা আপনাকে দেখেছে আপনি কতোটা জানেন। তারা কিছুটা হলেও টের পেয়েছে আপনার লিমিট, পছন্দ করেছে এবং এখন আপনাকে আরও ভালো করে পুতা-পাটায় পিষে মিলিয়ে নেবার জন্য ডাকছে। আপনি তাদের সাথে কাজ করার জন্য গুড ফিট কিনা এটা কনফার্ম করতে চাচ্ছে।
হয়তো আপনি ফোনে যা বলেছেন পুরোটাই ভুয়া, অথবা নিজেকে এতো জ্ঞানী ভাবেন যে একজন টেকনিশিয়ান দেখে নাক ছিটকাতে দুবার ভাবেন না। হবে না। আর আপনার চেয়েও আরও কাবিল দুজনকে তারা ডাকবে একই ভাবে আসার জন্য। হয়তো ওরা আপনার চেয়ে বেশী যোগ্য হবে এবং আপনি জবটা পাবেন না। এটা কোনই সমস্যা না। সবই যদি আপনি পান তাহলে অন্যরা কি করবে? শুধু এটা মাথায় রাখেন, আপনি আইন্সটাইন হতে পারেন কিন্তু আপনি যে একজন হাম্বল হিউম্যান বিইং এটা প্রমান করার দরকার আছে। আর ভিতরে এটা না থাকলে পুরো একদিনের কথাবার্তায় এটা প্রকাশ পাবেই। ঠেকাতে পারবেন না এবং কেউই একজন বিগটকে জেনে শুনে জব দেবে না। অনসাইট ইন্টারভিউয়ে আমার কাছে মনে হয় দুটো ধাপ আছে। একটা হচ্ছে নিজেকে প্রিপেয়ার করা এবং দ্বিতীয়টা হচ্ছে যেভাবে নিজেকে প্রিপেয়ার করেছেন সেটা প্রিসাইস ভাবে এক্জিকিউট করা। কোনটাতেই একটু ল্যাগিং থাকলে হয়তো জবটা ছুটে যাবে। তাই এই লেখাটা শুধু মাত্রই লজিস্টিক প্রিপারেশন নিয়ে। পরেরটা লিখলে লিখব টেকনিক্যাল প্রিপারেশন নিয়ে এবং শেষেরটা একজিকিউশন নিয়ে।


ব্যাকগ্রাউন্ডঃ আপনার কন্টাক্ট পারসনের কাছ থেকে স্কেজুয়ালটা নিয়ে নিন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কে কে আছে ওই লিস্টে দেখুন। আগের মতই তাদের নাড়ি-নক্ষত্র জানার চেষ্টা করুন। শুধু প্রফেশনালি না বরং তারা পারসনাল লাইফে কেমন এটাও খুজে বের করুন। টুইটার, ফেইসবুক, লিঙ্কড ইন সব ভাজা ভাজা করে ফেলুন। তাদের ছবি দেখুন। বোঝার চেষ্টা করুন সে কেমন হতে পারে। যত বেশী তাদের সাইকলজী বুঝতে পারবেন তত বেশী ইজি হবে আপনার জন্য এ্যান্সার করা। সবচেয়ে সহজ উপায় বলি, একটা এজেঞ্চিকে টাকা দিয়ে সম্ভব হলে তাদের ইনফর্মেশন গুলো জেনে নিন। একটু খরচ হবে কিন্তু আপনার জন্য কেউ তো আসলে অনেক অনসাইট ইন্টারভিউ নিয়ে বসে নেই তাই যেটাই পান সেটার সুযোগটাকেই কাজে লাগান। প্রতিটাতেই যাবেন জব পাওয়ার উদ্দেশে।
লজিস্টিকঃ ইন্টারভিউ লোকেশন গুগল করুন। আপনার কোথায় যেতে হবে, কোন ট্যাক্সিকে ফোন করবেন, অথবা গাড়ি নিলে কোন জায়গা থেকে নেবেন এগুলো সব যেন জানা থাকে। সম্ভব হলে কথা বলে নিন যে আপনি প্রেফার করেন ট্যাক্সি ক্যাব। তাতে লাভ যে আপনাকে ড্রাইভ করতে হবে না, জায়গা/পার্কিং খুজে পাবার ভেজাল থাকলো না। অফিস কোথায়, আসেপাশে কি রেস্টুর্যান্ট আছে দেখে নিন কারন ইন্টারভিউয়ের আগে বা পরে হয়তো আপনাকে ড্রেস চ্যেইন্জ করতে হতে পারে। কনফার্ম হয়ে নিন এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল এবং হোটেল থেকে ইন্টারভিউ লোকেশন ঠিক কতো দূরে এবং কেমন সময় লাগে যেতে। ওখানে গিয়ে কার সাথে কন্টাক্ট করবেন তার ফোন নাম্বার, ইমারজেন্সি নাম্বার সমস্ত কিছু প্রিন্ট করে নিন। লজিস্টিক গুলো আগে ক্লিয়ার করে রাখুন।


গিফটঃ তাদের প্রত্যেকের জন্য একটা চমৎকার গিফট নিয়ে যান। এটা অমি রহমান স্পেসাল। ঢুষ খেয়ে খেয়ে বের করেছি কারন এটা আমি আসলেই কোথাও পড়িনি। একটা ফাইল রেডি করুন খুব অল্প কিছু সলিড ম্যাটেরিয়াল দিয়ে। আমি খেয়াল করেছি সবাই অনেক এপ্রিশিয়েট করে। এটা কিন্তু শুধু আপনার প্রেজেন্টেশন বোঝায় না, এটা আমার মনে হয় আরও একটা ব্যাপার ডিফাইন করে যে আপনি ভেবেছেন এবং নিজেকে প্রিপেয়ার করেছেন। যে ম্যাটেরিয়াল গুলো আমি এর ভিতরে দেই সেগুলো হল, কাভার লেটার, রেজুমি, দুটো জব রিলেটেড পাব্লিকেশন, দুটো কাজ রিলেটেড নিউজ পেপার আর্টিক্যাল, গত বছর গুলোর পারফরমেন্স রিভিউ সামারি (সরাসরি ম্যানেজারের কমেন্টের স্ক্যান কপি), একটা প্রচণ্ড রিসেন্ট টেকনিক্যাল কাজ, রেফারেন্স লেটার, প্যাড এবং একটা কলম। সব কিছু একটা ফাইলে দিয়ে উপরে ইনসাইড ম্যাটেরিয়াল লিস্ট দিয়ে দেই যাতে তাদের দেখতে সুবিধা হয়। পাতায় পাতায় পেইজ মার্কার থাকে লিস্টের সাথে মিলিয়ে যাতে তাদের খুজে পেতে সুবিধা হয়। এগুলো কিনার সময় টাকার হিসেব খুব বেশী করিনা। আমি নিশ্চিত ভাবে আরও একবার বলি, এটা আমাকে অনেক উপকার করেছে।
লাগেজঃ লাগেজ গুছিয়ে ফেলুন। জামা কাপড়, রিলেটেড ডকুমেন্ট, টুথ ব্রাশ, পেস্ট, বডি পারফিউম, মাথা ধরার মেডিসিন, অফ-দা-শেলফ একটা ঘুমের মেডিসিন, গাম, জুতা সব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখুন। আর ইন্টারভিউ দেয়া শেষ হলেও এটা এসেই আবার গুছিয়ে ফেলুন। কারন আরও তো যেতে হবে। তাই এটা সব সময় গোছান থাকাই ভালো। হাত দিবেন না শুধু ইন্টারভিউতে যাওয়া ছাড়া। নেইল কাটার, খুচরা পয়সা নিয়েছেন তো? মনে করুন আর একবার কি কি নেয়া যেতে পারে।


পড়ুনঃ রিভাইজ দিয়ে ফেলুন এতদিন যা যা করেছেন, যা যা জেনেছেন। যেই ফোল্ডার গুলো দেখা দরকার সেগুলো দেখে নিন। পারলে মুখস্ত করে ফেলুন। এই নলেজটাই কাল আপনার সম্বল। ওরা এগুলো থেকেই কোয়েশ্চেন করবে। রেজ্যুমিটা আরও কয়েকবার পড়ুন। আপনার যেন নিশ্চিত ভাবেই জানা থাকে রেজ্যুমির কোথায় কোন ওয়ার্ড আপনি লিখেছেন এবং কেন লিখেছেন। একবার পড়া হয়ে গেলে আবার পড়ুন। আবার পড়ুন। যেই প্রশ্ন গুলো লিখে নিয়ে এসেছেন সেগুলো মুখস্থ করে ফেলুন। এটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। ফাতাফাতা করুন সব।
ফোল্ডারঃ প্রচণ্ড প্রফেশনাল একটা ফোল্ডার হাতে রাখুন যেটা নিয়ে ইন্টারভিউয়ের টেবিলের উপরে রাখবেন। সমস্ত কিছু যেন প্রফেশনাল হয়। ইকোনো পেন দিয়ে হাত ঝাড়ি দিয়ে দিয়ে কিছু লিখবেন আর ভাববেন আপনি জবটা পাবেন তাহলে তো ভাই হবেনা। একবার ভাবুন এটা শুধু তাদেরকেই খুশী করার জন্য না বরং আপনিও যে প্রফেশনাল এটা প্রমান করার জন্যই দরকার। সম্ভব হলে তাদের চোখ কপালে উঠে যাবার মতো একটা ফোল্ডার খুজে বের করুন। যত দামই হোক না কেন, কিনে ফেলুন। এটা একটা সুন্দর সময়ের জন্য ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট।
খাবারঃ লান্চে তো আপনাকে নিয়ে যাবেই। খাবারের এটিকেট গুলো শিখুন। ইউটিউব দেখুন। এমনিতে পা তুলে বসে খাবার অভ্যাস থাকলেও এই সময়টাতে অন্তত প্রফেশনালি বসার চেষ্টা করুন। বোঝেননি বোধহয়, টেবিলের উপর কনুই না রেখে খাওয়া কিন্তু বেশ কঠিন। আপনি যদি সহজাত এমন হন তাহলে তো ভালো কিন্তু আমার মতো মফিজের এটা অনেক প্রাক্টিস করে আয়ত্ত করতে হয়েছে।

রাতঃ গিয়ে পৌছাবার পর সব জিনিষ আলাদা করে রাখুন। সকালে উঠেই যাতে জাস্ট নিয়ম করে সব গুছিয়ে নিতে পারেন। আগেই রুমে ডু-নট-ডিস্টার্ব সাইন ঝুলিয়ে দিন। রুম পরিস্কার করার দরকার নেই। যা ইচ্ছা করেন কিন্তু মনে মনে যেগুলো পড়ে এসেছেন সেগুলো রিভাইজ দিতে থাকুন। আপনি কাল ফাটিয়ে দেবেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা এখন।
নোটঃ ফোন ইন্টারভিউয়ের সময় যে কোয়েশ্চন গুলো ওরা জিজ্ঞাসা করেছিল সেগুলো পড়ে ফেলুন। যেগুলো তখন এ্যান্সার করতে পারেননি সেগুলো তো আগেই খুজে খুজে এ্যান্সার বের করে রেখেছেন, ঝালাই করে নিন। অন্য আরও ইন্টারভিউতে যে সব কোয়েশ্চন করেছিল সেগুলো রিভাইজ করে ফেলুন। একটা বা দুটো কমন পড়ে গেলেও তো লাভ আর কমন পরবেই। দুনিয়াতে আপনি যেমন সব কিছু জানেন না তেমন যারাই বোর্ডে বসে আছে তারাও সব কিছু জানেনা। এটা মাথায় রাখুন।
এই পর্যন্তই থাকুক। এই পর্যায়ে এসে আসলে করার আর তেমন কিছু থাকেও না। আপনি যা যা করার সব করেছেন। এখন যদি না হয় তাহলে আর কি করা। পরের বারে আরও ভালো করার চেষ্টা করবেন। ভেঙ্গে পড়ার মতো কিছুই ঘটেনি। আপনি আজ না হোক কাল ফাটিয়ে দিবেনই। নিশ্চিত থাকেন।
১১/০৮/২০২২, ১০.০০ AM