বাংলাদেশ

ই-কমার্স নাকি ই-প্রতারনাঃ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

বিশ্বে ই-কমার্সের সূত্রপাত হয়েছিল আমেরিকায় ১৯৯৪ সালে। অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য কেনা-বেঁচায় গত এক দশকে বাংলাদেশেও শুরু হয়; যা এই করোনাকালে এসে আগের চেয়ে অনেকাংশে বেড়ে গেছে।

বর্তমান সরকারের আমলে, মোবাইলে ইন্টারনেটের সহজ লভ্যতা, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর প্রতি সঠিক নজরদারী ও মানুষের স্মার্ট ফোন ব্যবহারের কল্যানে মানুষ ঘরে বসে অনলাইনে মেনা-কাটার প্রতি ঝুকে পড়ে।

একই সময়ে এই সরকারের আমলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

যার ফলে ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে ই-কমার্স ক্ষাতে আরো বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠে। আর এ কারণেই বাংলাদেশে গতি সঞ্চার হয় ই-কমার্স খাত।

অনলাইন কেনাকাটাই মানুষের প্রথম পছন্দ
ঘরে বসে অনলাইন কেনাকাটাই মানুষের প্রথম পছন্দ

অভিনব সব ফাঁদ

২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসার প্রসার ঘটা শুরু করলেও দিন বদলের সাথে সাথে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। শুরুতেই সরকারের সঠিক নজরদারী ও নিয়মনীতি না থাকার দরুন ২০১৬ সালের ভেতরেই গ্রাহক প্রতারণা যেন তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

কিছু ই-কমার্স প্লাটফর্ম ক্যাশব্যাক/ডিসকাউন্ট/সাইক্লোন অফারে ২০% থেকে ১০০% বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেখা যায়। এমন চটকদার বিজ্ঞাপনে গ্রাহক পন্য ক্রয়ের জন্য হুরমুরিয়ে পড়েন তার কারন একটাই, মূল টাকা ফেরত পাওয়ার পাশাপাশি পন্য প্রাপ্তির সুযোগ।   

নীতিমালা ও নির্দেশিকা

বাণিজ্য মন্ত্রনালয় ডিজিটাল কমার্স (ই-কমার্স এবং এফ কমার্স) পরিচালনায় একটি প্রাথমিক নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এ সকল নীতিমালা শুধুমাত্র কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে এর কতোটা প্রয়োগ হচ্ছে তা কিন্তু ভাববার বিষয়।

গ্রাহক ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ের বিরুদ্ধেও।

নতুন এ নীতিমালা নিম্নরূপ –

  • ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে পণ্য সরবরাহ ও রিফান্ড দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
  • ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও ক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে।
  • ভিন্ন শহরে অবস্থান করলে দশ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
  • পণ্য স্টকে না থাকলে সেটার কোন পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না।
  • আগাম পরিশোধ করা টাকা পণ্য সরবরাহের পরই বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা হবে।
  • ক্রেতার অগ্রিম মূল্য পরিশোধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্যটি ডেলিভারিম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে জানাবে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো।
  • পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারিম্যান পণ্যটি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেবে।
  • সর্বোচ্চ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা সেবা ডেলিভারিম্যানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় না থাকলে ই-কমার্স কোম্পানি পণ্য মূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ অগ্রিম নিতে পারবে না।

তবে নীতিমালা ভঙ্গ করলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, যেমন কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল করা। কিন্তু এক্ষেত্রে নীতিমালা ভঙ্গ করলে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেওয়ার কোন সুযোগ থাকছে না।

অনলাইনে খাবার অর্ডার বেশ জনপ্রিয়
বর্তমান সময়ে অনলাইনে খাবার অর্ডার বেশ জনপ্রিয়

গ্রাহক অনাস্থায় ই-ক্যাব

একদল ফেসবুক ইউজার মিলে “ই-ক্যাব” নামে একটি ফেসবুক পেইজ খোলার মধ্যে দিয়ে সকল ই-কমার্স ব্যবসায়িদের আহ্বান জানান এই গ্রুপের সাথে যুক্ত হতে।

সময়ের পরিক্রমায় এই গ্রুপ বড় হয়ে গেলে তখন তারা সরকারের ডিজিটাল নীতিনির্ধারক কর্মকর্তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে সকল ই-কমার্স ব্যবসায়িদেরকে একটি প্লাটফর্মে আনতে কিছুটা সফল হন। এই সমিতি শুরু থেকেই সংগঠনের সদস্যদের ই-কমার্স খাতের নীতিমালাটি মেনে ব্যবসা পরিচালনার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

কিন্তু সময়ের পরিক্রমায়, গ্রাহক-ভোক্তা ছাড়াও খোদ ই-কমার্স ব্যবসায়ীরাই এই ই-ক্যাব নামক সমিতির বিরুদ্ধেও জোরালো অভিযোগ পেশ করেছেন।

ভোক্তারা যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তুলেছেন সেগুলোর মধ্যে ই-ক্যাব সদস্যভুক্ত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেটা খুব বেশি হলে সদস্য পদ বাতিল বা স্থগিত করা। এরচেয়ে বেশি কিছু করার এখতিয়ার ই-ক্যাবের নেই।

সরকারের ভূমিকা

ই-কমার্স ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় যে নীতিমালা ও নির্দেশিকা জারি করেছে সেটা যদি মেনে চলা যায় তাহলে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা যাবে ও আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে। কিন্তু এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যেন ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়ের মতো না হয়ে যায় আবার।

তার কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে আটকে যাওয়া টাকা বা পণ্য উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যাবে।

এক্ষেত্রে সরকারের উচিত আলাদা একটি কমিটি গঠন করে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিচালনার ধরন বা মডেল পর্যালোচনা করা ও মন্ত্রনালয় কতৃক প্রদেয় নিয়মনীতিমালায় সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় ফিরিয়ে এনে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা।

অনলাইন কেনাকাটায় ই-কমার্স
অনলাইন কেনাকাটায় ই-কমার্স এখন দেশের গুরুত্বপূর্ন একটি অর্থনৈতিক খাত

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ই-কমার্স

আমাদের দেশে ই-কমার্স সাইটের যাত্রা এক দশক আগে শুরু হলেও ২০১৩ এর দিকে এসে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

বিশেষ করে ২০১৯ এর শেষের দিকে বিশ্বে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশব্যাপী লকডাউনের সময়ে বিভিন্ন ই-কমার্স ও ফেসবুকভিত্তিক এফ-কমার্স সাইটগুলো হয়ে ওঠে মানুষের কেনাকাটার অন্যতম মাধ্যম।

সাধারণ জনগন চাল-ডাল, তেল-নুন থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক পণ্য, গাড়ি, মোটরসাইকেল কিনতেও ই-কমার্স সাইটগুলোর ওপর সম্পূর্নরূপে নির্ভরশীল হয়ে পরেন।

আর সেই বাজার ধরতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি পাড়া, মহল্লা, এলাকা কিংবা উপজেলা ভিত্তক ক্ষুদ্র ও মাঝারী গোছের ব্যবসায়িরাও দোকানদারীর পাশাপাশি চালু করেছে নিজেদের অনলাইন ব্যবসা।

যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে অল্প সময়েই বিস্তার লাভ করে এই ই-কমার্স ব্যবসা।

বর্তমানে সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আনুমানিক ৩২০০ ই-কমার্স সাইট রয়েছে। ফেসবুকভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগ রয়েছে দুই লাখের বেশি। এসব প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন লক্ষাধিক পণ্যের অর্ডার ও ডেলিভারি হচ্ছে।

ই-কমার্স খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, বর্তমানে খাতটির আকার ১০ হাজার কোটি টাকা প্রায়। ২০৩০ সাল নাগাদ এ খাতের আকার ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অনলাইনে মূল্য পরিশোধ
অনলাইনে মূল্য পরিশোধ এখন আগের চেয়ে অধিক নিরাপদ

অর্থ লেনদেনে নতুন পদ্ধতি

বাংলাদেশের শির্ষস্থানীয় ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানও বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে আস্থা ধরে রাখতে পারছে না কোন কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের উপর।

তবে সুখবর হচ্ছে, নিরাপদ ও সহজেই মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থার জন্য একটি ‘এসক্রো সার্ভিস’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটা অনেকটা মধ্যস্বস্তভোগী সংস্থার মতো করে কাজ করবে।

এসক্রো সার্ভিস চালু হলে ক্রেতারা আগাম টাকা পরিশোধ করলেও পণ্য সরবরাহ না হওয়া পর্যন্ত ওই টাকা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হবে না যা অত্যন্ত নিরাপদ।

এছাড়া কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সময়মত পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে তবে সাত কার্য দিবসের মধ্যে গ্রাহককে মূল্য ফেরত দেয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

সর্বশেষে

সর্বোপরি একটাই চাওয়া, প্রচুর সম্ভাবনাময় এই খাতের প্রতি সরকারি সংস্থা তাদের সুদৃষ্টি জ্ঞাপন করবে এবং যারা প্রকৃত ই-কমার্স ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা প্রসারের পাশাপাশি গ্রাহক মনে আস্থার জন্ম দেবার লক্ষ্যে অবিচল কাজ করে যাবে। তবেই বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত চাঙ্গা হয়ে উঠবে এবং একদিন দেশিয় ই-কমার্স বর্হির বিশ্বে অ্যামাজোন, আলিবাবার মতোই আন্তর্জাতিক খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি নিজেদের ই-কমার্স ব্যবসা সম্প্রসারনে সক্ষম হবে।

৩০-০৩-২০২২, ১১.৪০ PM  

Mahbub Babu

আমার জন্ম সময়ের প্রয়োজনে। আমার জন্ম যুদ্ধের আয়োজনে। আমি মায়ের গর্ভেই শুনেছি যুদ্ধের ডামাডোল। আমি এসেছি ধ্বংসের বার্তা নিয়ে। সব প্রাচীর গুড়িয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে চলা আমি এক কালপুরুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *